বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে বিশ্বনাথবাসীর অবদান যুগ যুগ ধরে এ দেশের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। বিভিন্ন সময় স্থানীয়, জেলা ও জাতীয় বিভিন্ন আন্দোলনে বিশ্বনাথীরা অসীম সাহস, দৃঢ় মনোবল এবং ত্যাগের বিনিময়ে আন্দোলনকে সফলতার দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যেতে অনন্য ভূমিকা পালন করেন। নি¤েœ উল্লেখযোগ্য কয়েকটি আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরা হলোঃ
(ক) বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনঃ বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে উপজেলার লামাকাজী ইউনিয়নের দিঘলী গ্রামের ডাঃ সুন্দরী মোহন দাস, গোপী শুক্ল বৈদ্য, হেমেন্দ্র দাশ পুরকায়স্থ, শচিন্দ্র কুমার দত্ত, মোকেশ চন্দ্র দেব, রামপাশা ইউনিয়নের গড়গাঁও গ্রামের মরহুম আশরাফ আলী, দৌলতপুর ইউনিয়নের মৌলানা খলিলুর রহমান (উছমান খান) বিশ্বনাথ ইউনিয়নের জানাইয়া গ্রামের রসময় দত্ত চৌধুরী, সুধাশু ভট্টাচার্য্য, ঋৃষিন্দ্র কৃষ্ণ দত্ত চৌধুরী এবং হরিকলস গ্রামের পদ্মকেশ দেব, দশঘর ইউনিয়নের শায়খ সুলাইমান খান- এর অবদান অতুলনীয়। এর মধ্যে অনেকেই জেলও কেটেছেন সে সময়।
(খ) ভাষা আন্দোলনঃ রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে প্রতিষ্ঠিত করার দাবিতে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে দশঘর ইউনিয়নের দশঘর গ্রামের সাহিত্যিক জনাব মরহুম মোঃ নুরুল হক, একই ইউনিয়নের রায়খেলী গ্রামের জনাব মরহুম দবির উদ্দিন, নাছুনী গ্রামের জনাব মরহুম মোঃ ওয়ারিছ আলী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
(গ) মুক্তিযুদ্ধ বা স্বাধীনতা আন্দোলনঃ ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ পাক হানাদার বাহিনী যখন ঘুমন্ত বাঙালী জাতির উপর ঝাপিয়ে পড়ে তখন স্বাভাবিক কারণে দেশের স্বাধীনতার সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য এদেশের কৃষক, শ্রমিক, মজুর ও ছাত্র-জনতা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যেখানে যে অবস্থানে ছিলেন সেখান থেকে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। বিশ্বনাথ উপজেলার প্রায় দেড় শতাধিক বীর সন্তান বাংলাদেশের সবচেয়ে গৌরবপূর্ণ ও মর্যাদার মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে বিশ্বনাথের নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখে অত্র জনপদের মাটি ও মানুষকে গৌরবের আসনে অধিষ্টিত করেছেন। দুঃখজনক হলেও সত্য যে জাতির এই সুর্য সন্তানদের নামে বিশ্বনাথে কোন নাম ফলক বা স্মৃতি ফলক নির্মাণ করা হয়নি। তবে সিলেট মদন মোহন কলেজে ও সিলেট কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা সুলেমানের নামে দুটি হলের নাম করণ করা হয়েছে এবং দক্ষিণ সুরমায় তার নামে একটি প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা দীর্ঘ দিন ধরে চালু রয়েছে। এছাড়া মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে অসামান্য অবদান রাখার জন্য মুক্তিযুদ্ধের গৌরবপুর্ণ খেতাব বীরবিক্রম উপাধি পান অলংকারী ইউনিয়নের রামপুর গ্রামের সুবেদার (অব:) আব্দুল মালিক ও বীরপ্রতীক খেতাব পান দেওকলস ইউনিয়নের আগ্নপাড়া গ্রামের জনাব সিরাজুল ইসলাম।
অন্যদিকে ৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রবাস থেকে বহু বিশ্বনাথীরা মুক্তিযোদ্ধাদের তহবিল সংগ্রহে এবং বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জনমত সৃষ্টিতে অনন্য ভূমিকা রাখেন। আর তাদেরই একজন মরহুম গৌছ খান। উপজেলার দেওকলস ইউনিয়নের কজাকাবাদ গ্রামের এই কৃতি সন্তানকে বাংলাদেশ সরকার ২০১১ সালে স্বাধীনতা পদক (মরননোত্তর) প্রদান করেন। এবং বিশ্বনাথে লামাকাজী ইউনিয়নের দিঘলী গ্রামের ডক্টর অরুপ রতন চৌধুরী ৭১’র মহান মুক্তিযুদ্ধে শব্দ সৈনিক হিসাবে অনন্য ভুমিকা রাখার জন্য জাতীয় একুশে পদক পান।
(ঘ) সেক্টর ও মুক্ত দিবসঃ বিশ্বনাথের অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধা ৪নং ও ৫নং সেক্টরের অধিনস্থ এলাকা থেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। অবশেষে বিশ্বনাথ উপজেলা ১০ই ডিসেম্বর শক্র মুক্ত হয়। এর পর থেকে বিশ্বনাথে ১০ ডিসেম্বর মুক্ত দিবস পালন হয়ে আসছে।
(ঙ) জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আন্দোলনঃ ভারতে বাবরি মসজিদ, মধ্যপ্রাচ্যে ইরাক কর্তৃক কুয়েত দখল, আমেরিকা ও বৃটেন কর্তৃক আফগানিস্তান ও ইরাক দখল, গুয়ান্তানামায় কোরআন অবমাননার কারনে ও দেশে ইসলামের নামে জঙ্গি তৎপরতার বিরুদ্ধে বিশ্বনাথের রাজপথ সমাবেশ ও মিছিলে মিছিলে উত্তাল ছিল।
(চ) ৯০ এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনঃ ১৯৯০ সালে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে ঢাকার রাজপথে বিশ্বনাথের জনাব এম. ইলিয়াস আলী, সিলেটের রাজপথে জনাব শাহ মোদাব্বির আলী, জনাব আ.ন.ম শফিকুল হক, জনাব ইফতেখার হোসেন শামীম, জনাব নুরুল ইসলাম খান, এডভোকেট গিয়াস উদ্দিন, মুজিবুর রহমান চৌধুরী, নওশাদ আহমদ চৌধুরী, শাহ ফরিদ আহমদ, শাহ মোশাহিদ আলী, অধ্যক্ষ হাসমত উল্লাহ, সাংবাদিক হারুনুজ্জামান চৌধুরী, মোঃ বশির উদ্দীন, মুকতাবিস উন নুর, আজিজুল হক মানিক, আমজাদ হোসাইন, আ ফ ম সাঈদ, তাপস দাস পুরকায়স্থ প্রমুখ ব্যক্তি বর্গের অসামান্য অবদান গণতান্ত্রিক আন্দোলন প্রতিষ্ঠার ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
(ছ) সিলেট বিভাগ আন্দোলনঃ ১ কোটি সিলেটবাসীর প্রাণের দাবী সিলেট বিভাগ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে বিশ্বনাথবাসীরাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সিলেট শহরে রাজনীতিবিদ জনাব গিয়াস উদ্দিন এডভোকেট, জনবা, আ ন ম শফিকুল হক, জনাব ইফতেখার হোসেন শামীম, জনাব নুরুল ইসলাম খান, জনাব শাহ মোদাব্বির আলী, জনাব এম ইলিয়াস আলী, স্বর্গীয় প্রীতিলতা পুরকায়স্থ, জনাব শাহ ফরিদ, জনাব শাহ মোশাহিদ আলী সাংবাদিক হারুনুজ্জামান চৌধুরী, মোঃ বশির উদ্দীন, মুকতাবিস উন নুর, আজিজুল হক মানিক, আমজাদ হোসাইন, আ ফ ম সাঈদ, তাপস দাস পুরকায়স্থ ও বিশ্বনাথের স্থানীয় রাজনীতিবিদরা নিজ নিজ দলের ব্যানারে থেকে আন্দোলন করেন।
(জ) অর্পিত সম্পতি আইন বাতিল আন্দোলনঃ অর্পিত সম্পত্তি নামে কালো আইন বাতিলের দাবীতে সারা দেশের ন্যায় বিশ্বনাথীরাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। ঢাকা শহরে জয়ন্ত সেন দিপু। সিলেট শহরে বিশিষ্ট আইনজীবি দেবতোষ চৌধুরী, সুখময় ধর খোকা বাবু), প্রদীপ দেব, রজত কান্তি গুপ্ত, দেবব্রত দত্ত চৌধুরী (মৃদুল) এবং বিশ্বনাথের রাজপথে স্থানীয় নেতৃবৃন্দরা আন্দোলন করছেন।
(ঝ) শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় আন্দোলনঃ শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে জাহানারা ইমামের নামে একটি হলের নাম করন বিরোধী আন্দোলনে সিলেটে রাজনীতিবিদ জনাব গিয়াস উদ্দিন এডভোকেট, জনাব এম ইলিয়াস আলী, জনাব ফখর উদ্দিন আহমদ, জনাব অধ্যক্ষ হাসমত উল্লাহ প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
(ঞ) তসলিমা নাসরিন বিরোধী আন্দোলনঃ ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে কুখ্যাত লেখিকা তসলিমা নাসরিনের কটাক্ষ করার প্রতিবাদে বিশ্বনাথের বিভিন্ন আলীয়া, কওমী মাদ্রাসা সমূহ ও বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক সংগঠন একই ব্যানারে ও পৃথক পৃথক ব্যানারে আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করেন।
(ট) ইলিয়াস মুক্তি আন্দোলন: ২০১২ সালে ১৭ই এপ্রিল এই জনপদের প্রাক্তন এমপি নিখোঁজ এম ইলিয়াস আলী ঢাকা থেকে নিখোজ হন। তাঁর সন্ধানের দাবিতে সারাদেশে সৃষ্ট আন্দোলন প্রচন্ড বিক্ষোভে রুপ নেয়। আর বিশেষ করে বিশ্বনাথে স্থানীয় ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ আন্দোলনে পরিনত হয়। ২২শে এপ্রিল ২০১২ সালে প্রায় ৪ ঘন্টাব্যাপী জনতা পুলিশ মুখোমুখি সংঘর্ষে ৩টি সম্ভাবনাময় তাজা প্রান অকালে ঝরে যায় এবং পুলিশসহ প্রায় শতাধিক ব্যাক্তি মারাত্বকভাবে আহত হন। আর বিশ্বনাথ উপজেলা সদরের প্রায় এক কিলোমিটার এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়।