৪ঠা জুন, ২০২৩ ইং | ২১শে জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

মৌলভী মুহাম্মদ নূরুল হক

প্রকাশিত হয়েছে: এপ্রিল - ২৯ - ২০১৭ | ৯: ০৪ অপরাহ্ণ | সংবাদটি 1232 বার পঠিত

সুসাহিত্যিক ও পাঠাগার আন্দোলনের পথিকৃৎ মৌলভী মুহাম্মদ নুরুল হক জীবদ্দশায় ভাষা,সাহিত্য এবং মানবকল্যানে অনন্য অবদান রাখেন ।
বাংলাদেশের প্রাচীনতম পত্রিকা মাসিক আল-ইসলাহর এর প্রতিষ্টাতা ও আজীবন সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদের প্রতিষ্টাতা সাধারন-সম্পাদক ছিলেন বিশ্বনাথের মৌলভী মুহাম্মদ নুরুল হক। একজন সুসাহিত্যিক ও পাঠাগার আন্দোলনের পথিকৃৎ হিসেবে দেশজুড়ে তার নাম রয়েছে। তিনি ১৯০৭ সালের ১৯ শে মার্চ বিশ্বনাথ উপজেলার দশঘর ইউনিয়নের দশঘর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহন করেন। তার পিতার নাম আলহাজ্ব মুহাম্মদ আয়াজ এবং মাতার নাম রাহিমা খাতুন । তার পিতা একজন বিখ্যাত আলেম ও ফার্সি সাহিত্যের অতিশয় অনুরাগী ছিলেন। আর মাতা ছিলেন অত্যন্ত ধর্মপরায়ন ,আদর্শবান বিনয়ী প্রকৃতির মহিলা । নয় ভাই বোনের মধ্যে মুহাম্মদ নুরুল হক ছিলেন পঞ্চম ।
মৌলভী মুহাম্মদ নুরুল হক শৈশবে নিজ গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে তার শিক্ষাজীবন শুরু করেন । তিনি বিভিন্ন পত্র পত্রিকা অত্যন্ত মনোযোগের সাথে পড়তেন । হৃদয় দিয়ে অনুভব করার চেষ্টা করতেন এর অন্তর্নিহিত বক্তব্য । এ সময় থেকেই তার মনে সাহিত্যের বীজ অংকুরিত হতে থাকে । মুহাম্মদ নুরুল হক সিলেট সরকারী আলীয়া মাদ্রাসায় অধ্যয়নকালে অভিযান নামে হাতে লেখা একটি ত্রৈমাসিক পত্রিকা বের করেন। সিলেট সরকারী আলিয়া মাদ্রাসায় অধ্যয়নকালে মুহাম্মদ নুরুল হক মানবিক সমস্যার সম্মুখিন হন বার বার । কিন্তু হাল ছাড়েননি। তার দৃঢ় আত্ম বিশ্বাস ,অপরিসীম ধৈর্যশক্তি এবং একাগ্রতার বলে তিনি প্রতিকূল পরিবেশকে জয় করে পত্রিকা প্রকাশের মতো অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করতে সক্ষম হন। প্রতিকূল পরিবেশের সাথে সংগ্রাম করে মুহাম্মদ নুরুল হক ও পরাজিত হননি । বিধ্বস্ত হননি বরং তিনি জয়লাভ করে তার অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখেন ।

কিন্তু কালের পরিক্রমায় অভিযান এর নাম পরিবর্তন করে এর নামকরন করা হয় আল-ইসলাহ । মুহাম্মদ নুরুল হক সম্পাদক পদেই বহাল থাকেন । সিলেট সরকারী আলীয়া মাদ্রাসায় প্রায় তিন শতাধিক গ্রাহক পাওয়া যায় । অন্যান্য বেশ কিছু গ্রাহক এবং উপযুক্ত সাড়া পাওয়া যায় । এতে ঘাত প্রতিঘাতকে পিছনে ফেলে ১৩৩৯ বাংলার অগ্রহায়নে আত্ম প্রকাশ করে নুহাম্মদ নুরুল হকের সম্পাদিত মাসিক আল ইসলাহ । আল-ইসলাহ ছিলো সিলেট মুসলমান সম্পাদিত প্রথম মাসিক পত্রিকা ,আলেম সমাজকে বাংলাভাষা চর্চার প্রতি অনুপ্রাণিত এবং মাতৃভাষা বাংলার মাধ্যমে সাহিত্য সেবা এবং ইসলামী সংস্কৃতি ও তমদ্দুনের বিকাশ সাধনই ছিলো আল-ইসলাহর আদর্শ উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য । ছাত্রাবস্থায় মুহাম্মদ নুরুল হক দুই বছর পত্রিকা সম্পাদক ও পরিচালনা করেন। ১৯৩৬ সালের মাদ্রাসার শেষ পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে পাস করে তিনি কর্মক্ষেত্রে ঝাপিয়ে পড়েন। তার একাগ্রতায় আল ইসলাহর ক্ষেত্র সম্প্রসারিত হয়।
মুহাম্মদ নুরুল হক ছাত্রজীবন থেকেই বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় লেখালেখি শুরু করেন। সিলেট ও কলকাতায় বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় তার প্রচুর লেখা ছাপা হয় । একটি সাহিত্য সংগঠন প্রতিষ্টার যে তীব্র আকাঙ্খা নুরুল হকের অন্তরাত্মা আস্তে আস্তে দানা বেধে উঠেছিল। ১৯৩৬ সালের ১৬ই সেপ্টেম্বর প্রতিষ্টিত হয় সিলেট কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ। মাত্র ১৯ খানা বই নিয়ে এর যাত্রা শুরু হয়। এতে সভাপতি নির্বাচিত হন খান বাহাদুর দেওয়ান একলিমুর রাজা এবং সম্পাদক নির্বাচিত হন নুরুল হক । সে দিনই তিনি তার আজন্মের সাধনার ধন আল-ইসলাহকে মুসলিম সাহিত্য সংসদের মুখপাত্র হিসেবে দান করেন এবং জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি আল ইসলাহ ও মুসলিম সাহিত্য সংসদের সম্পাদক হিসেবে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য সেবা এবং মানবকল্যানে নিজের জীবন উৎসর্গ করে নানা প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে সংগ্রাম করেছেন ।

মুহাম্মদ নুরুল হক ১৯৬৩ সালে তৎকালীন পাকিস্তানের ১৭তম স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে সাহিত্য ও সমাজ সেবার স্বীকৃতি স্বরুপ স্বর্নপদক ও তৎসঙ্গে তঘমা ই খিদমত উপাধি এবং পরবর্তী স্তরে সাহিত্যিক বৃত্তি লাভ করেন। গ্রন্থাগার আন্দোলনের অনবদ্য অবদানের জন্য ১৩৮৪ বাংলায় ১লা বৈশাখ জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্র কতৃক স্বর্নপদক ও সংবর্ধনা লাভ করেন। ১৯৮৬ সালের ৪ জানুয়ারী বাংলা একাডেমী কর্তৃক সম্মানসূচক ফেলোশীপ প্রদান করা হয় ।১৯৮৭ সালে মৌলভী মুহাম্মদ নুরুল হককে মৃত্যুর ১ দিন পূর্বে আমীনুর রশীদ চৌধুরী স্মৃতি স্বর্ণপদক প্রদান করা হয় ।
ব্যক্তিগত জীবনে তিনি মোছাম্মৎ নুুরুননেচ্ছা হকের সাথে বিবাহ বন্দনে আবদ্দ হন ।তিনি ও ছিলেন একজন লেখিকা। সুখী এই দম্পতি ছিলেন ১০ সন্তানের জনক ও জননী। তাদের সকল সন্তানই আজ স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্টিত । বিশ্বনাথের এই কীর্তিমান পুরুষ ১৯৮৭ সালের ২রা সেপ্টেম্বর ইন্তেকাল করেন।

error: Content is protected !!