উপমহাদেশের প্রধান মরমী কবি হাসন রাজার উপয্ক্তু সন্তান কাব্যবিশারদ দেওয়ান একলিমুর রাজা চৌধুরী। পিতার পাশাপাশি নিজের নাম ও ইতিহাসে লিখে গেছেন স্বীয় যোগ্যতায় । স্বীকৃতি পেয়েছেন কাব্য বিশারদ হিসেবে ।
এই উপমহাদেশের অন্যতম প্রধান মরমী কবি হচ্ছেন দেওয়ান হাসন রাজা । যাকে এক নামে সবাই চিনে ।সেই উপযুক্ত পিতার উপযুক্ত সন্তান কাব্যবিশারদ দেওয়ান একলিমুর রাজা ।পিতার পাশাপাশি নিজের নাম ও ইতিহাসে লিখে গেছেন স্বীয় যোগ্যতায় ।স্বীকৃতি পেয়েছেন কাব্য বিশারদ হিসেবে । দেওয়ান একলিমুর রাজা ১৮১৯ সালে বিশ্বনাথ থানার অন্তর্গত রামপাশা গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। তার মায়ের নাম মোছাম্মৎ ছজিদা (সাজেদা বেগম) । ছোট কালে মায়ের বুকভরা ভালবাসা ,পিতার স্নেহ তেমন একটা পাননি একলিমুর রাজা ।কারন মা ছিলেন অত্যন্ত ধার্মিক । বয়স যখন তিন তখন মা চলে যান পবিত্র হজ্বব্রত পালনের উদ্দেশ্যে মক্কা শরীফ ।
পিতা হাছন রাজা বিশাল জমিদারী ,পরিবার পাইক পেয়াদা আর গান বাজনায় ব্যস্ত ।আর তাই ছোট একলিমুর রাজার প্রতি তেমন একটা সময় দেয়া হয়নি হাছন রাজার ।ভাবিত জীবনের মধ্য দিয়ে একলিমুর রাজা বেড়ে উঠেন ।যার কারনে আট বছর বয়স হলেও বাল্য শিক্ষা শুরু করতে পারেননি তিনি । দেরীতে হলেও মন্টু বাবু নামক এক ব্রাহ্মন মাস্টারের অধীনে একলিমুর রাজার বাল্য শিক্ষা শুরু হয় । এরপর সুনামগঞ্জ জুবিলী হাই স্কুলে ভর্তি হন । সেখানে কিছুদিন অতিবাহিত করার পর তাকে ভর্তি করা হয় সিলেট গভর্নমেন্ট হাইস্কুলে । সিলেটে কিছুদিন লেখাপড়া করানোর পর তাকে ঢাকায় একটি স্কুলে ভর্তি করা হয় । তারপর তিনি কলকাতায় একটি স্কুলে কিছুদিন লেখাপড়া করেন। কলকাতা স্কুলে পড়াকালীন সময়ে তার শিক্ষা জীবনের ইতি ঘটে এবং সংসার ধর্ম পালনের জন্য বাড়ি ফিরে আসেন । বাড়িতে ফিরে আসলেও ভ্রমনের নেশা তাকে পেয়ে বসে এবং সময় সুযোগ পেলে ভারতের নানাস্থানে ভ্রমন করতে থাকেন । একাডেমিক শিক্ষার উচ্চমাপের সার্টিফিকেট না থাকলেও বংশানুক্রমিক গুনাবলী নানা স্থানে ঘুরে বেড়ানোর অভিজ্ঞতা এবং বিভিন্ন পন্ডিত ব্যক্তির সান্নিধ্য তার প্রতিভা বিকাশের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল ।
একলিমুর রাজা তার কাব্যসাধনায় পিতা হাসন রাজার প্রতক্ষ অনুসারি হলেও গানে ও কবিতায় আধুনিকতার পরশ পাওয়া যায় ।মরমী ও আধুনিক উভয় ধারার কাব্য রচনায় তিনি ছিলেন সিদ্দহস্ত ।উভয় ধারার রচনায় তার সমন্বয় ঘটে ।এ জন্য দেওয়ান একলিমুর রাজাকে সিলেটের প্রথম আধুনিক কবি হিসেবে অভিহিত করা হয় । যেমন – নদীর পারে ছিল আমার ছোট কুঁড়ে ঘর /চালের পাশে খোপে বসে ডাকত কবুতর । কিশোর বয়সে এক যুবতী নারীর প্রতি তার আকর্ষন বাড়ে ।বিয়ের পর যুবতী স্বামী গৃহ থেকে ফেরত এলে কবির সাথে সাক্ষাৎ হয় । যুবতীকে দেখে কবি হৃদয়ে গভীর ভাবের উদ্রেক হয় । আর তাই কবি লিখেন :
;তোমার নয়ন দিয়ে পড়লো যখন /বসন বেয়ে নয়ন ধারা
তখন আমার আখির মাঝে /ভিজলো কেন আঁখি তারা
সেই থেকেই কাব্য সাধনা শুরু । তিনি লিখতে থাকেন কবিতা ।তার লেখা কবিতা গান তৎকালীন সময়ে যে সকল পত্র পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে ছাপা হতে থাকে সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ভারতবর্ষ ,প্রবাসী ,আল ইসলাহ ,ইত্যাদি । কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাইঝি সরলা দেবী চৌধুরীর দ্বারা অনুরুক্ত হয়ে তিনি কলকাতার এক কবিতা পাঠের আসরে স্বরোচিত দেবতার পরিনাম নামক কবিতা পাঠ করে অশেষ খ্যাতি অর্জন করেন।
কোন অপার /সিন্দু হয়ে পার /ধীরে ও অধীরে/অন্তরে অন্তরের বুক চিরে চিরে /দিবস যাত্রীর সাথে যাত্রী হয়ে পার / আপন প্রণয়ে মুগ্ধ হয়ে আপনার /মৃত্যু হতে অমৃত সঞ্চিত করি পান/ অভিনব জীবনের করিতে সন্দান ।
দেবতার পরিনাম ,কবিতা প্রকাশিত হওয়ার পর নবদ্বীপের সারস্বত সমাজ তাকে কাব্যবিশারদ উপাধিতে ভূষিত করেন।জানা যায় যে একমাত্র লর্ড রোনাল্ডসে ব্যতিত অন্য কোন অহিন্দুকে এ উপাধি দেয়া হয়নি । এ কবিতার ব্যাপারে জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম বলেন বঙ্গ সাহিত্যের তিনটি শ্রেষ্ঠ কবিতার মধ্যে এই কবিতাটি অন্যতম ।বড় বড় কবি সাহিত্যিকদের সংস্পর্শে আসার জন্য একলিমুর রাজা পথের ক্লান্তিকে তুচ্ছ মনে করে শত কষ্ট করে তাদের সাক্ষাত লাভ করেন।১৯২৫ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে প্রথম সাক্ষাত ঘটে শিলং ।এ সময় তার সাথে ছিলেন বড় পুত্র দেওয়ান তৈমুর রাজা চৌধুরী ।একলিমুর রাজা কবি গুরুকে স্বরোচিত কৃপন কবিতাটি পাঠ করে শোনান ।
তুমি মোরে যা করেছ দান /জীবন যৌবন ধন মান
রিক্ত হয়ে মুক্ত হই ঋন করি শেষ ,শূন্য হয়ে ধন্য হইয়া পুরাইয়া তোমার আদেশ
কবিতাটি শুনে কবিগুরু হেসে হেসে বলেছিলেন তোমার পিতার কাছ থেকে পাওয়া জিনিস হারিয়োনা যতœ করে রেখো ।১৯২৮ সালে আসাম মুসলিম ছাত্র ফেডারশনের আমন্ত্রনে সিলেট আসেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম । তখন একলিমুর রাজা বিদ্রোহী কবির সম্মানে এক চা চক্রের আয়োজন করেন।
তিনি লেখেন
তুমি এলে আমার দেশে দিব উপহার / বন্ধু কি আছে আমার
এই ধান ক্ষেতের বান ডেকেছে মান করেছে বৌ/ রাগের বশে ছুয়না ওরা পিপড়া ভরা মৌ।
এ সময় তার উপরুক্ত স্বরুচিত কবিতা পাঠ করে শূনালে নজরুল কবির কাব্য শক্তির অনুভবে মুগ্ধ হয়ে পড়েন ।কবি নজরুল আর একলিমুর রাজার মধ্যে ঐ সময় আরও বিভিন্ন বৈঠকে মেলামেশা হওয়ায় নজরুল তার কবিতা ও গানের পাঠ শুনেন । ফলে উভয়ের মধ্যে পরম প্রীতি ও হৃদ্যতা জন্মে ।কারন উভয়ই একই আদর্শ ও ভাবধারায় অনুপ্রাণিত ছিলেন ।১৯৩৭ সালে পল্লী কবি জসীম উদ্দিন আসেন মুসলিম ছাত্র সম্মেলনী অনুষ্টানে ।সিলেটে কবির আগমন উপলক্ষে মুসলিম সাহিত্য সংসদের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা প্রদান করা হয় ।সংসদের পক্ষ থেকে দেওয়ান একলিমুর রাজা কবিকে একখানা ছাপানো মানপত্র প্রদান করেন।সংবর্ধনা শেষে একলিমুর রাজা রচিত একটি পল্লী গান পরিবেশিত হয় ।সূরের মূর্চনায় ও ভাবের আবেশে পল্লী কবি অত্যন্ত অভিভূত হয়েছিলেন ।পাখি কইও বন্দুয়ার লাগ পাইলে /ফিরে যদি আসে বন্দু একলিম রাজা মইলে .একলিমুর রাজা শুধু কবি বা দার্শনিক ছিলেন না ।তিনি একজন প্রাজ্ঞ রাজনীতিবিদ ও ছিলেন ।তিনি একাধারে কবি রাজনীতিবিদ ,সমাজসেবক ,এবং দার্শনিক ।
তিনি ১৯৩৭-১৯৪৬ সাল পর্যন্ত আসাম প্রাদেশিক পরিষদের মেম্বার ছিলেন ।এছাড়া ১৯২৫ সাল থেকে ১৯২৮ সাল পর্যন্ত সিলেট লোকাল বোর্ডের মেম্বার ছিলেন ।তিনি দীর্ঘদিন অনারারি ম্যাজিস্ট্রেট ও ঋনশালীশী বোর্ডের অনারারী ডাইরেক্টার এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো ছিলেন । এক সময় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর্টের সদস্য ছিলেন ।তিনি যখন আসাম প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য তখন সাদউল্লাহ মন্ত্রী সভার Ministril party চেয়ারম্যান ও আসাম টেক্সটবুক কমিটির সদস্য ছিলেন । তিনি মুসলিম সাহিত্য সংসদ সিলেট এর প্রথম সভাপতি ছিলেন । জীবদ্দশায় একলিমুর রাজা আসামের গভর্নর লর্ড আর ইউন কর্তৃক প্রদত্ত খান বাহাদুর ও নবদ্বীপের স্বারস্বত সমাজ প্রদত্ত কাব্য বিশারদ উপাধিতে ভূষিত হন।
তিনি তিনশত কবিতা ও আড়াইশত গান রচনা করে সাহিত্যজগতে তার আসন পাকাপোক্ত করে নেন । গীতি মেঘনা ছাড়া তার কোন লিখা বই আকারে প্রকাশিত হয় নি । তার অনেক গুলি পান্ডুলিপি ছিল সেগুলি হচ্ছে উপন্যাস মায়ের বিয়ে চতুরঙ্গ ,বিশুধা ভাবী ,ভূলন মিয়ার ভুল । কবিতা এক ঢেউ ,হরেক রঙের ,জারজ। গানের বই প্রাণের কথা গানে ,হারানো মানিক ,গীত মেঘনা ।একলিমুর রাজার আতœজীবনীমূলক লেখা আমার সাহিত্য জীবনের ইতিকথা । ।১৯৬৪ সালের ১৩ আগস্ট ইংল্যান্ডের পোর্টসমাউথ হাসপাতালে তিনি ইন্তেকাল করেন।রামপাশা পারিবারিক গোরস্থানে তাকে সমাহিত করা হয়।