বিশ্বনাথের ডাঃ সুন্দরী মোহন দাস সিলেটের প্রথম এম.বি.বি.এস ডিগ্রীধারী চিকিৎসক
বিশ্বনাথের ডাঃ সুন্দরী মোহন দাস সিলেটের প্রথম ব্যক্তি, যিনি আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসে প্রথম এম.বি.বি.এস ডিগ্রীধারী। ডাক্তারী ও প্রসূতি বিদ্যা বিভাগে ১৮৭৯ সালে প্রথম স্থান অধিকার করে তিনি এম.বি.বি.এস ডিগ্রী অর্জন করেন। ডাঃ সুন্দরী মোহন দাস বিশ্বনাথ উপজেলার লামাকাজি ইউনিয়নের অন্তর্গত দীঘলী গ্রামে ১৮৫৭ সালে জন্মগ্রহণ করেন।সুন্দরী মোহন দাসের পিতার নাম দেওয়ান স্বরুপ চন্দ্র দাস এবং মায়ের নাম অন্নপূর্না দেবী । তিনি ছিলেন জমিদার বংশের সন্তান । তার পিতা স্বরুপ চাঁদ ছিলেন তৎকালীন কৌড়িয়া পরগনার প্রখ্যাত জমিদার ।সুন্দরী মোহন দাস প্রাইজ সাহেবের স্কুল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে ১৮৭৩ সালে সিলেট গভর্মেন্ট হাই স্কুল থেকে ম্যাটিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন । এরপর তিনি বন্দু বিপিন চন্দ্র পাল এর সাথে কলকাতায় যান এবং কলকাতা প্রেসিডেন্সী কলেজে ভর্তি হন সেখান থেকে তিনি ১৮৭৫ সালে এফ এ পাশ করেন ।এফ এ পাশ করার পর ডাক্তারী ও প্রসূতি বিদ্যা বিভাগে ১৮৭৯ সালে প্রথম স্থান অধিকার করে এম.বি.বি.এস ডিগ্রী অর্জন করেন।
বিশ্বনাথের এই কৃতি সন্তান সিলেটের প্রথম ব্যাক্তি যিনি আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসে প্রথম এম.বি.বি.এস ডিগ্রীধারী চিকিৎসক। ডাঃ সুন্দরী মোহন দাস রাজনৈতিক ভাবেও ছিলেন সচেতন । তার একটি বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন রয়েছে। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী।কর্মজীবনে তিনি প্রথমেই হবিগঞ্জ জেলার Health inspector হিসেবে যোগদান করেন এবং দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালনের জন্য কর্তৃপক্ষের সন্তোষ্টি অর্জন করেন আর অল্পদিনের মধ্যেই তিনি কলকাতার কর্পোরেশন এর ডাক্তার হিসেবে বদলী হন। সে সময় কলকাতায় মহামারী আকারে প্লেগ রোগ দেখা দেয় ,ফলে গুদামজাত পণ্যের বিনাশের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় । এই পণ্য বিনাশ করতে গিয়ে ভারতীয়দের গুদামজাত পণ্য বিনাশ করা হয় এবং ইংরেজদের গুদামজাত পণ্য বিনাশ না করে যথাস্থানে রাখা হয় । এর প্রতিবাদ করতে গিয়ে সুন্দরী মোহন দাস স্বেচ্ছায় চাকুরী থেকে পদত্যাগ করেন। এরপর তিনি স্বাধীনভাবে ডাক্তরী ব্যাবসা শুরু করেন।
সিলেটি ছাত্রদের কাছে ব্রাহ্মম ধর্ম প্রচারের নিমিত্তে ১৮৭৬ -৭৭ সালে সুন্দরী মোহন ,বিপিন চন্দ্র ,তারা কিশোর প্রমুখ মিলে শ্রী হট্ট সম্মিলনী নামক সংগঠন প্রতিষ্টা করেন।এই সংগঠন সিলেটে শিক্ষা প্রসারে এবং বিশেষ করে সিলেটের হিন্দু ও মুসলিম পরিবারের নারীদের শিক্ষা প্রসারে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। ১৯০৫ সালে শিবনাথ শাস্ত্রীর উপস্থিতিতে বুকের রক্ত দিয়ে লিখে সুন্দরী মোহন ও বিপিন চন্দ্র চারটি শপথ গ্রহণ করেছিলেন এবং জীবনের শেষ অবধি সে গুলো অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলেন ।শপথগুলো নিম্নে উল্লেখ করা হল ।(১)সরকারী চাকুরী করব না (২)বৃটিশদের দাসত্ব করবনা (৩) প্রয়োজনের অতিরিক্ত সঞ্চয় করব না (৪)দেশের স্বাধীনতার জন্য যথা শক্তি আন্তনিয়োগ করব।
১৯২০ সালে সিলেট শহরের সুরমা উপত্যাকা রাষ্ট্রীয় সমিতির পঞ্চম অধিবেশনে অনুষ্টিত হয় এবং এতে সুন্দরী মোহন দাস এক সারগর্ভ বক্তব্য প্রদান করেন ।এই বাক্যের মাধ্যমে তিনি অসহযোগ আন্দোলনের সাথে পুরোপুরি একাতœতা ঘোষনা করেন।সুন্দরী মোহন দাস এর পারিবারিক জীবন ছিল খুবই ঘটনা বহুল ।আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত সুন্দরী মোহন তখন বাইশ বছরের তেজোদিপ্ত তরুণ । রক্তে তার উজ্জল প্রবাহ । প্রথা ভাঙ্গার নেশা যেন তাকে পেয়ে বসেছিল ।সবার উপরে মানুষ সত্য এ নীতিবাক্যের মোহে তিনি বাপ দাদার আচরিত ও পালিত প্রথা ভেঙ্গে ফেলেন ।তিনি ব্রাহ্ম ধর্ম গ্রহন করলেন। শুধু তাই নয় একজন বিধবা তরুণীকে বিবাহ করে মানুষের মর্যাদাকে সর্বোচ্চ তুলে ধরেন । তার এরুপ ঘটনায অনুপ্রাণিত হয়ে তার ঘনিষ্ট বন্দু বিপিন চন্দ্র সমাজচ্যুত হন।
কিন্তু এতে তারা মুষড়ে না পড়ে যে যার মত জীবন নির্বাহ করতে শুরু করলেন ।কারন তাদের মনে ও সমাজে তখন আধুনিক মানসিকতায় বিদ্রোহী স্রোত।সুন্দরী মোহন দাসের দুই পুত্র প্রেমানন্দ ও যোগানন্দ । পুত্রদ্বয়কে তিনি নিজের আদর্শে মানুষ করেছেন । প্রেমানন্দ আমেরিকা থেকে উচ্চতর ডিগ্রী নিয়ে এসে পিতার স্থাপিত ঔষধ প্রস্তুতকরক সংস্থা Standard Pharmaceutical ; এ কাজ করেছেন। উল্লেখ্য যে সুন্দরী মোহন এর স্থাপিত Standard এবং ইউনিভার্সেল ড্রাগ হাউস এর মাধ্যমে তার উত্তর পুরুষেরা আজ অবধি ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন।এখানে প্রসংগত উল্লেখ করা দরকার যে সুন্দরী মোহন এর প্রথম পুত্র প্রেমানন্দ এর স্ত্রী সুবর্ণা প্রভা দাশ কলকাতার মহিলা গ্রাজুয়েট তিনি শিলং এ নারী শিক্ষা প্রসারে গার্লস হাইস্কুলে প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে স্মরণীয় হয়ে আছেন।
সুন্দরী মোহন ছিলেন জাতীয় শিক্ষা পরিষদের অন্যতম প্রতিষ্টাতা সদস্য । এ পরিষদের প্রযুক্তি বিদ্যা শাখা থেকেই বর্তমান যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় এবং এর ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষাকেন্দ্রের সৃষ্টি ।পরিষদের চিকিৎসা সংক্রান্ত ভাগকে কেন্দ্র করে প্রতিষ্টিত হয়েছে জাতীয় মেডিকেল স্কুল এবং এর পথ ধরেই সৃষ্টি হয়েছে চিত্ত রঞ্জন ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ ।
সুন্দরী মোহন ছিলেন চিত্ত রঞ্জন ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজের প্রতিষ্টাতা ও প্রথম অধ্যক্ষ । চিত্ত রঞ্জন সেবা সদন গড়ে ওঠে চিত্ত রঞ্জনের আর্থিক সহযোগীতায় সুন্দরী মোহন ছিলেন এ প্রতিষ্টানের প্রথম অধ্যক্ষ । সুন্দরী মোহন এর স্মৃতি রক্ষার্থে ও সুন্দরী মোহনকে বাচিয়ে রাখার জন্য কলকাতায় সি আই টি রোডের নামকরন হয়েছ সুন্দরী মোহন এভিনিউ। তাছাড়া ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজে স্থাপিত হয়েছে সুন্দরী মোহনের একটি আবক্ষ মূর্তি ।শুধু তাই নয় প্রসূতি বিদ্যা প্রসঙ্গে সুন্দরী মোহন বৃদ্বাধাত্রীর” রোজনামচা ”নামক যে গ্রন্থ লিখে গেছেন তা চিকিৎসক ও মেডিকেল ছাত্রদের একটি আবশ্যক পাঠ্য গ্রন্থ।যার পঠন পাঠন সুন্দরী মোহনকে অনেক যুগ বাচিয়ে রাখবে নিঃসন্দেহে।সুন্দরী মোহন বহু গুনের অধিকারী ছিলেন ।
তিনি একাধারে প্রখ্যাত ডাক্তার ,সাহিত্যিক ,উদ্যোমী সংগঠক ,নিষ্টাবান ব্রহ্মচারী ,দূরদর্শী রাজনৈতিক,আদর্শ পিতা নানা প্রতিষ্টানের প্রতিষ্টাতা ,এমনকি তিনি একজন সুগায়ক সংগীতজ্ঞ ও ছিলেন।তিনি” নৌকা বিলাস” পালা ও ঊষাকালে প্রভৃতি সাহিত্য বিষয়ক লিখা লেখেন।নৌকা বিলাস পালা নাটকটি রবীন্দ্রনাথের জোড়াসাকোতে নিজে অভিনয় করেছেন।রসিক চরিত্রের মানুষ সুন্দরী মোহন মাত্র ৩৮ লাইনে নিখাদ সিলেটি ভাষায় সমগ্র রামায়ন সাত খন্ডের মূল ভাব রসাত্নক ও অবিকৃত ভাষায় বর্ণনা করেছেন।সুন্দরী মোহনের বেশ কিছু রচিত গ্রন্ত রয়েছে । চিকিৎসা বিজ্ঞানের মূল্যবান গ্রন্ত বৃদ্ধধাত্রীর রোজনামচা ,সরল ধাত্রী শিক্ষা ”স্বাস্থ্যবিজ্ঞান ”শুশ্রষা বিদ্যা ’কুমার তন্ত্র ’সাহিত্য বিষয়ক গ্রন্ত্রের মধ্যে রয়েছে নৌকাবিলাস পালা ”ঊষা কালে ভজন সংগীত ইত্যাদি।
মানুষ বয়স নয় তার কর্মের মধ্যে বেচে থাকে এই চিরন্তন সত্য বাণিটির মত সুন্দরী মোহনও বেচে আছেন তার কর্মের মধ্যে ।আর এই কীর্তিমান পুরুষ সারা জীবন রাজনীতি ,সমাজসেবা ,সাহিত্য ,সেবা স্কুল কলেজের প্রতিষ্টাতা শিল্প প্রতিষ্টান ,ঔষধ কারখানা প্রতিষ্টার সাথে সংশ্লিষ্ট থেকে ১৯৫০ সালের ৪ঠা এপ্রিল কলকাতার তার নিজের স্থাপিত কলেজ এন্ড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।